প্রবাহবার্তা আহমেদ সাব্বির রোমিও : মুলত ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই মুক্তি সেনারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে এই বাংলা মাটিতে বিজয়ের লাল সবুজ পতাকা উড়িয়ে বিশ্ববাসীর কাছে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নাম তুলে ধরতে শুরু করেছিলো। একে একে আত্মসমর্পণ করতে থাকে পাক-হানাদার বাহিনীর সদস্যরা এরই ধারাবাহিকতায় আজ ১১ ডিসেম্বর কুমিল্লার বর্তমান লাকসাম উপজেলা পাক-হানাদার বানিনী থেকে লাকসাম কে মুক্ত করে। সে কারনেই ১১ ডিসেম্বরকে ধরা হয় লাকসাম মুক্ত দিবস হিসেবে। আজ ঐতিহাসিক লাকসাম মুক্ত দিবস। ১৯৭১ এর এই দিনেপাক বাহিনীর কবল থেকে কুমিল্লা জেলার লাকসাম অঞ্চলকে মুক্ত করেন স্বাধীনতা মুক্তি পাগল জনগণ। ২৫ মার্চ ঢাকা জেলা শহরে পাক বাহিনী বাঙালি নিধন শুরু করলে লাকসামের মুক্তি পাগল মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে লাকসামের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। মুক্তিযুদ্ধে লাকসামের বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গসহ স্বাধীনতাকামী স্কুল-কলেজের ছাত্র-শিক্ষক ও পলাতক সৈনিক সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত করা এবং সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য লাকসামকে চারটি সেক্টরে ভাগ করা হয়। ১নং, ২নং, ৩নং, ৪নং সেক্টর ছিল যৌথ কমান্ডের অধীন। পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, চার দিকের যে কোন দু-দিকের ত্রিভুজ সীমা নিয়ে গঠিত চারটি জোনের কমান্ডের সঙ্গে একাধিক প্লাটুন গেরিলা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। এফএফ কমান্ড ও বিএলএফ কমান্ড হিসেবে পরিচিত এ বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে শক্তিশালী ছিল। লাকসামের তৎকালীন চাঁদপুর টোবাকো ফ্যাক্টরি (বর্তমানে ইন্ডাট্রিজ) এ জায়গায় ‘৭১’ সালে পাক হানাদার বাহিনীর যুদ্ধের ঘাঁটি ছিল। উত্তরে বিজয়পুর এবং পশ্চিমে চাঁদপুর, দক্ষিণে সোনাইমুড়ী এবং পূর্বে ভারত সীমান্ত ছিল পাক বাহিনীর যুদ্ধের এলাকা। পাক ফৌজের ঘাঁটি ছিল লাকসাম। অস্ত্র ও যুদ্ধের যাবতীয় উপকরণ লাকসাম হতে সরবরাহ করা হতো, নোয়াখালী ও বৃহত্তর চট্টগ্রামের সাথে স্থলপথে যোগসূত্র ছিল লাকসাম। পাক বাহিনী তৎকালীন চাঁদপুর টোবাকো ফ্যাক্টরি (বর্তমানে ইন্ডাট্রিজ) এ জায়গায় নিজেদের ঘাঁটিতে মানুষকে ধরে এনে নির্বিচারে হত্যা করে লাকসাম রেলওয়ে জংশনের দক্ষিণে বেলতলী নামক স্থান বর্তমান বধ্য ভূমিতে পুতে রাখত। পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে লাকসাম জংশন এলাকার সশস্ত্র বাহিনী গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় লাকসামের আজগরা ইউনিয়নের বড়বাম গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাক বাহিনীর প্রচন্ড সংঘর্ষ বাঁধে। এ লড়াইয়ে দুজন মক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। নাম ফলকে এ দু-জনের চিহ্ন আছে। লাকসামের হাসনাবাদ এলাকা লাল হাসনাবাদে পরিণত হয়। সেখানে পাকবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধে ২২ জন শহীদ হন। হাসনাবাদের গ্রাম গুলো পাক-বাহিনী জ¦ালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। লাকসামের গৈয়ার ভাঙ্গা এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধে চারজন দেলোয়ার, হারুন, মোকলেছ ও মনোরঞ্জন শহীদ হন। খিলা রেলওয়ে স্টেশনে হাজিগঞ্জের দুই ছাত্রবন্ধু আনোয়ার ও আকরম আলী পাকবাহিনীর হাতে ধৃত হয়ে শহীদ হন। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন লাকসাম অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে বহু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মোস্তফা কামাল ও সোলায়মান দুই ভাইয়ের স্মৃতি কেউ ভুলতে পারবে না। তারা দুইজন লাকসামের উদ্দীয়মান সাহিত্য কর্মী ছিলেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মিশ্রী জংশন শহীদ আবদুল খালেক, কামড্ডা গ্রামের শহীদ আবুল খায়ের, কামড্ডা গ্রামের শহীদ আবুল খায়েরের স্মৃতি বহন করছে। একাত্তরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সম্বলিত তালিকার একটি স্মৃতি ফলক লাকসাম থানা মুক্তিযুদ্ধ সংসদের সামনে প্রতিষ্ঠা করা আছে। মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের দায়িত্বে প্রথমে ছিলেন ক্যাপ্টেন আবদুল জলিল ওরফে লাল মিয়া বুড়িচং। পরবর্তী পর্যায়ে যোগদান করেন কর্নেল মাহব্বু, বিগ্রেডিয়ার দিদারুল আলম, মেজর এনাম আহমেদ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি খোরশেদ আলম, ফ্লাইট সার্জন সিদ্দিকুর রহমান প্রমুখ।