প্রবাহবার্তা : আমাদের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে বাসযোগ্য, পরিবেশসম্মত আধুনিক আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ঢাকা শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে এবং ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ ধারণাকে কার্যকর করে নাগরিক সুবিধা সব মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য কাজ করছে সরকার। সারা বিশ্বকে বাসযোগ্য, পরিবেশসম্মত ও সমৃদ্ধ আধুনিক বিশ্বে পরিণত করার যে বিশ্বব্যাপী পরিকল্পনা, এর রোল মডেল বাংলাদেশ। এ রোল মডেল হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুপরিকল্পিতভাবে বিশ্ব বসতি দিবস পালনের নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা চাই সব মানুষ সম্মিলিতভাবে পরিকল্পিত আবাসন গড়ে তুলুক। সবার জন্য আবাসন নিশ্চিতকরণসহ বাসযোগ্য ও নিরাপদ আবাসস্থলের বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৮৬ সাল থেকে বিশ্বে অক্টোবরের প্রথম সোমবার জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব বসতি দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে।
‘নগর ও গ্রামের বৈষম্য দূরীকরণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকার প্রত্যেক গ্রামে শহরের সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। আবাসন ও অন্যান্য নাগরিক সেবার চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে নগর উন্নয়ন কর্মসূচির রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। সঠিক পরিকল্পনা ও গবেষণার মাধ্যমে ভ‚মির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে পরিকল্পিত নগরায়ন ও টেকসই ও নিরাপদ অবকাঠামো নির্মাণই হলো অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্যে। আবাসন খাতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ উন্নততর নগরায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।’
‘স্বল্প আয়ের নাগরিকদের জন্য জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুসারে সাশ্রয়ী মূল্যে নগর আবাসন নিশ্চিত করতে অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।’
অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে আধুনিক ও সময়োপযোগী প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ কর্মসূচি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘গ্রামে শহরের সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে শতভাগ বিদ্যুতায়ন, গ্রামে পাকা সড়ক নির্মাণ, রেল সংযোগ বৃদ্ধি, ভূমির পরিকল্পিত ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতকরণে ডিজিটাল ল্যান্ড জোনিং, কৃষি ও আবাসনের জমির মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষার উদ্দেশ্যে শহরগুলোর জন্য মাস্টার প্ল¬্যান প্রস্তুত করাসহ বহুমাত্রিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার মনে করে, সবার জন্য আবাসন, কেউ থাকবে না গৃহহীন। এটি ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার। এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য সরকার কাজ করে চলেছে। দেশের বিত্তবান, মধ্যবিত্ত, নি¤œমধ্যবিত্ত, এমনকি যাদের কোনো কিছু নেই অর্থাৎ যারা ভাসমান বস্তিবাসী তাদের জন্য সরকার বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। একজন লোকও দেশে আবাসহীন থাকবে না। জনগণের সাংবিধানিক অধিকার বাসস্থান বাস্তবায়নের জন্য এইচবিআরআই কাজ করে যাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রতিকূলতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনন্য দক্ষতা ও সাফল্য প্রদর্শনের সুবাদে সমগ্র বিশ্বের কাছে আজ একটি রোল মডেল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের মহাসচিব জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজনের জন্য বাংলাদেশকে একটি মডেল হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজনে বাংলাদেশ সেরা শিক্ষক।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতাদের মধ্যে অন্যতম যিনি জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি নিয়ে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’
‘সবার জন্য পরিবেশসম্মতভাবে আবাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরকার সারা বিশ্বে রোল মডেল হবে। সারা দুনিয়ায় যেমন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন শেখ হাসিনা, এ ক্ষেত্রেও তাঁর নেতৃত্ব থেকে সারা দুনিয়া শিক্ষা গ্রহণ করবে।’
আবাসন মানুষের অন্যতম প্রধান একটি মৌলিক চাহিদা। আর্থ-সামাজিক খাত, জনসংখ্যার চাপ, জমির অপ্রতুলতা, নগরায়ন ও শিল্পায়ন সবকিছু বিবেচনায় এনে শহর-গ্রামে প্রতিটি জনবসতিতেই এখন পরিকল্পিত আবাসন জরুরী।
দেশের প্রচলিত নির্মাণ কর্মকান্ডের গুণগত মান বৃদ্ধিকরণ এবং নতুন উপকরণ উদ্ভাবন ও নির্মাণ কৌশল উন্নয়নের লক্ষ্যে গবেষণার গুরুত্ব সর্বজনবিদিত। এ লক্ষ্য সামনে রেখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ হাউজিং এন্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট গবেষণার কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা এবং উদ্ভাবিত নির্মাণ উপকরণ ও পদ্ধতিসমূহ সম্প্রসারণের জন্য কাজ করে চলেছে।
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে যেখানে সম্পদ অত্যন্ত সীমিত এবং ভূমির তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অত্যন্ত বেশী, সেখানে গবেষণার মাধ্যমে নির্মাণ উপকরণ ও সম্পদের অপচয়রোধ, মিতব্যয় অনুশীলন ও মান নিয়ন্ত্রণের উপায় জনপ্রিয়করণ এবং প্রচলিত নির্মাণ পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক নতুন নির্মাণ উপকরণ ও কৌশল উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা একান্তই অনস্বীকার্য।
সম্পদের সীমাবদ্ধতার সঙ্গে জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হওয়া সত্তে¡ও অভিযোজন এবং প্রশমনে বিশ্বে বাংলাদেশ সফলতা পরিচয় দিয়েছে। এই ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সরকার ‘প্রতি বছর বাংলাদেশ জলবায়ু অভিযোজন এবং টেকসই অবকাঠামো নির্মাণে ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। যা আমাদের জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ।’
৫০টি স্বল্পোন্নত দেশ যারা বিশ্বের ১ শতাংশের মতো গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী, তারাই এই নিঃসরণজনিত কারণে সৃষ্ট জলবায়ু সংকটের শিকার হয়! রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা বিশ্বসভায় এই দেশগুলোর স্বার্থরক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর প্রভাব এবং দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে শেখ হাসিনার সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নিজস্ব অর্থায়নে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি ক্লাইমেট ট্রাস্ট তহবিল গঠন করে। শুধু তাই নয় ২০১৫ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত এই খাতে ব্যয় করবে আরও চার হাজার কোটি ডলার। এর পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এবং পানি ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ প্রণয়ন করেছে।
দেশের শতকরা ৭২ ভাগ লোক গ্রামে বসবাস করে এবং দেশের মোট গৃহের ৮১ ভাগ গ্রামে অবস্থিত। এই ৮১ ভাগ গৃহের মধ্যে ৮০ ভাগই নি¤œমানের কাঠামো। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে যত্রতত্র বাড়িঘর নির্মাণ করায় প্রতিদিন প্রায় ২৩৫ হেক্টর কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে দেশ খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়বে।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধানের ১৬নং অনুচ্ছেদে নগর ও গ্রামের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে নাগরিকদের আবাসন সমস্যা দূরীকরণে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সবার জন্য পরিকল্পিত আবাসনের মাধ্যমে ভবিষ্যতের উন্নত নগরায়ন নিশ্চিতকরণে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। সরকার এ লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের নাগরিকদের জন্য জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে নগর আবাসন নিশ্চিত করতে অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের জেলা শহরের পাশাপাশি বিভিন্ন উপজেলায় প্লট ও ফ্ল্যাট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। কোনো নাগরিকরা যাতে বস্তিতে বসবাস করতে না হয় সেজন্য সরকার বস্তিবাসীদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ করছে। বস্তিবাসীদের জন্য ১৬ হাজারের বেশি ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন গবেষণা কর্মে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করছে এইচবিআরআই।
ইতোমধ্যে আবাসন খাতের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় এবং সুপরিকল্পিত নগরায়নের জন্য ‘জাতীয় আবাসন নীতি-২০১৭’ এবং ‘হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট আইন-২০১৮’ প্রণয়ন করা হয়েছে। গৃহায়ন নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন, ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-১১’ অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে আধুনিক ও সময়োপযোগী প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ কর্মসূচি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
লেখক:মো. আশরাফুল আলম,
মহাপরিচালক, এইচবিআরআই।