প্রবাহবার্তা, আহমেদ সাব্বির রোমিও : ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা। জানতে পারলাম এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী ঢাকায় আসছেন শো করতে। আমি তখন বগুড়ার বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা ” দৈনিক করতোয়া “র ঢাকা প্রতিনিধি। পাশাপাশি দৈনিক বাংলারবানীর সাথে যুক্ত। ১৯৮৪ থেকে দৈনিক করতোয়া সাথে আমি যুক্ত। সে সময় করতোয়া ছাপা হতো লেটার প্রেসে। দাম ছিলো ৪০ পয়সা। করতোয়া সম্পাদক মোজাম্মেল হক লালু ভাই এর সাথে আমার খুবই ভালো সম্পর্ক। বাবার চাকুরীর সুবাদে বগুড়ায় থাকা। পড়ালেখার পাশাপাশি সাংবাদিকতার নেশা। যাই হোক খেলাঘর করার কারণেই লালু ভাইএর সাথে সখ্যতা আরো গভীর হলো।নতুন বাংলা খেলাঘর আসর তখন বগুড়াতে বেশ আলোচিত শিশু কিশোর সংগঠন। লালু ভাই সেই সংগঠনের উপদেষ্টা। আমিও এই সংগঠনের সদস্য হিসেবে ৮০ দশকের শুরুর দিকে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগীতায়সারা বাংলাদেশের মধ্যে অভিনয়ে প্রথম হয়ে তাক লাগিয়ে দেই। সুযোগ পাই বিটিভির শিশু কিশোর অনুষ্ঠান ” অংকুর ” উপস্থাপনার। অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা করতেন বিশিষ্ট সাংবাদিক, সংগঠক কিশার বাংলার সম্পাদক চাঁদেরহাট এর প্রতিষ্ঠাতা রফিকুল হক দাদু ভাই। আমি ভখন নিয়মিত কিশোর বাংলায় লেখা লেখি করি। এটা আমার জন্য প্লাস হলো। বিটিভি অডিশনে টিকে গেলাম। রফি আহমেদ সুলতান ” অংকুর ” এর প্রযোজক ছিলেন। সেই ৮০ দশকেই আমি বগুড়া থেকে বের করতাম শিশু কিশোর পত্রিকা ” অংকুর “। আমার এই কাগজে লিখতেন কবি রুস্তমআলী, কর্নপুরী,তাজমিলুর রহমান, তৌফিক হাসান ময়না, শাহাদাত হোসেন ঝুনু, জি এম পারভেজ ড্যারিন। যাই হোক মূল কথায় আসি। ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বরের ঘটনা। আজাদ যশোরী নামের জনৈক কবি তার এক ভুইফোঁড় সংগঠন থেকে কবি মাইকেল মধুসুদন পুরষ্কার প্রদান করে। আজাদ যশোরী, তার সেই সংগঠন বা এই পুরষ্কারের নাম সে সময় অনেকেই কোনদিনই শুনে নাই। সে বছর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে তারা পুরষ্কারের জন্য নির্বাচিত করে। পুরষ্কার নিতে হেমন্ত যখন ঢাকায় এলেন সাথে তার সহধর্মিণী বেলা মুখোপাধ্যায়, কন্যা রানু মুখোপাধ্যায় সাথে ছিলেন। উঠেছিলেন শেরাটন হোটেলে। পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠানের পাশাপাশি আজাদ যশোরীর আয়োজনেই ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে তাঁর একক সঙ্গীতানুষ্ঠান করা হল। টিকিটের দাম ছিল ৫০০, ৩০০ এবং ২০০ টাকা।
এই অনুষ্ঠানের টিকেট বিক্রি করে ব্যবসা করাই বোধহয় হেমন্তকে পুরষ্কার দেয়ার কারন। এছাড়াও বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিশিষ্ট গীতিকার আবু হেনা মুস্তফা কামালের উপস্থাপনায় তাঁর একক অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। একঘন্টার এই অনুষ্ঠানে মাত্র চারটি গান পরিবেশন করলেও আবু হেনা এবং তাঁর দীর্ঘ আলাপচারিতা ছিল খুবই উপভোগ্য। আবু হেনা তাঁকে চতুর্থ গানের অনুরোধ জানালে তিনি উত্তর দেন – “আমি ক্ষমা চাইছি, এটাই কিন্তু শেষ অনুরোধ। আর অনুরোধ করবেন না। আমার বয়স হয়েছে, শরীর খুব একটা ভাল না”। এরপর তিনি গেয়ে শোনান – আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে পান্থ পাখীর কুজন কাকলী ঘিরে আগামী পৃথিবী কান পেতে তুমি শোনো আমি যদি আর নাই বা আসি হেথা ফিরে। এসব পুরষ্কার এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান চলাকালেই হঠাৎ পত্রিকায় খবর এল, হেমন্ত নাকি আয়োজকদের আচরনে প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। আয়োজকগোষ্ঠী বাংলাদেশে তার যে ধরনের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার কিছুই ঠিকমত পালন করা তো দূরের কথা, এত বড় শিল্পীকে যথাযোগ্য মর্যাদাও দেয়নি। এমনকি কবি যশোরী হেমন্তের পাসপোর্ট পর্যন্ত তার নিজের জিম্মায় রেখে দিয়েছে এবং হেমন্ত বারবার চাওয়ার সত্ত্বেও ফেরত দিচ্ছিল না। এসময় তাঁর বয়স ছিল ৬৯ বছর এবং ঢাকায় আসার কিছুদিন আগে তাঁর হার্টের অপারেশন হয়েছিল। এরকম অবস্থায় আয়োজকদের অসহযোগিতা এবং অব্যবস্থাপনায় তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরিস্থিতি মোকাবেলায় এবং বিদেশি ভিআইপি মেহমানের সম্মান রক্ষার্থে এরশাদ সরকার হস্তক্ষেপ করে। পুলিশ যশোরীকে গ্রেফতারও করে তার কাছ থেকে পাসপোর্ট উদ্ধার করে এবং হেমন্তের থাকা-খাওয়া ও দ্রুত দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। এমনকি সংসদেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। আমি তখন ঢাকায় অবস্থান করছি যে ভাবেই হোক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এর সাক্ষাতকার আমাকে নিতেই হবে।চলে গেলেম শেরাটন হোটেলে। কিন্তুু ঢাকার বাইরের কাগজ এর সাংবাদিক পাত্তা পাওয়া মুশকিল। লবিতে বসে আছি হটাৎ দেখলাম জাতীয় পার্টির নেত্রী নিলা চৌধুরী কে ( প্রয়াত চিত্রনায়ক সালমান শাহ্ -এর মা) একজন তরুণীকে সাথে করে উপরে যাচছন। আর দেরী না করে তার পিছু হাটা দিলাম কারণ আমি আগেই জেনে ছিলাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এর কন্য তার বান্ধবী রানু মুখোপাধ্যায়। নীলা চৌধুরীর সাথে যে সুন্দরী তরুণীটি ছিলো এটাই রানু মুখোপাধ্যায়। যাই হোক সরাসরি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যেই রুমে ছিলেন সেখানে চলে গেলাম নীলা চৌধুরী পরিচয় করিয়ে দিলেন। করতোয়া ঢাকার বাইরে জনপ্রিয় কাগজ এটা বুঝাতে সক্ষম হলেন। আমি আমার কাজ চালিয়ে যেতে থাকলাম। নিজের জেনিথ ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছি আর ফাঁকেফাঁকে কথা বলছি।
কি কথা সসব আগেই লিখছি।হাতে সময় কম কারণ তারা যাবেন বিটিভিতে। আমি নিলা চৌধুরীকে বললাম বিটিভির অনুষ্ঠানে আমিও যেতে চাই। সব ঠিক হলো ঝামেলা হলো ক্যামেরা নিয়ে। এখনকার মতো তখন বিটিভিতে চাইলেই কেউ ক্যামেরা নিয়ে ঢুকতে পারতেন না। পূর্ব অনুমতি নিতে হতো। আজকালতো যপ কেউ বিটিভিতে ঢুকেই মোবাইলে সেলফী তুলেন! যাইহোক নিলা চৌধুরীর সুবাদে ক্যামেরা নিয়ে ঢুকার অনুমতি পেলাম। নীলা চৌধুরীর গাড়ীতে চড়েই বিটিভি গেলাম। বিটিভির অডিটোরিয়ামে একুশের পদক প্রাপ্ত গীতিকার আবু হেনা মোস্তোফা কামাল উপস্থাপকের ভুমিকায় বসে আছেন। আমরা দর্শকসারীতে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করছি। প্রখ্যাত এই শিল্পী ভারতে ফিরে যাবার দুই সপ্তাহের মধ্যেই সেপ্টেম্বরের ২৬ তারিখে তাঁর আরেকটি মেজর হার্ট অ্যাটাক হয় এবং সেদিনই রাত সোয়া এগারটায় এই মহান শিল্পী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আরো দুঃখজনক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মারা যাবার তিন দিন আগে ২৩শে সেপ্টেম্বর ‘৮৯ গীতিকার আবু হেনা মুস্তফা কামালও মারা যান! বিটিভির সেই অনুষ্ঠানটি ছিল দু’জনেরই শেষ টিভি অ্যাপিয়ারেন্স।