প্রবাহবার্তা : কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন এক হাতে তব বাঁশের বাশরী আর এক হাতে রণতুর্জ। আমাদের মনে রাখতে হবে ১৪ ই ফেব্রুয়ারীর সাথে আছে একটা ইতিহাস সেই ইতিহাস আমাদের ছাত্র ছাত্রীদের গর্বের ও ত্যাগের ইতিহাস। আমরা সবাই জানি ১৯৮২ সালের ২৪ শে মার্চ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে এবং বাংলাদেশের সংবিধান রহিত করে সাত্তারের জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিসভা বাতিল ঘোষণা করেন।একইসাথে তিনি নিজেকে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে সামরিক আইনে জারিকৃত সব বিধিবিধান ও আদেশকে দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে ঘোষণা করেন। একই বছর এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী ড.মজিদ খান একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। সেখানে প্রথম শ্রেণী থেকেই আরবি ও দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য মাপকাঠি করা হয় মেধা অথবা পঞ্চাশ শতাংশ ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা। এটি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয় এবং তারা ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু করেন।শিক্ষার্থীদের তিনটি দাবি ছিল, ১। মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল, ২। সব ছাত্র ও রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তিদান, ৩।সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এরশাদ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই দেশের প্রতিটি লড়াই সংগ্রামের মত প্রগতিশীল, মুক্ত চিন্তা ও মুক্তিযুদ্ধর আর্দশে বিশ্বাসি ছাত্র সংগঠন গুলো নানা প্রতিরোধে জন্য মুখিয়ে উঠে এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালের ৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবসে ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ মিছিল বের করার চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশি বাধায় সে মিছিল পণ্ড হয়ে যায়। ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার গণ অভ্যুত্থান দিবসে, ৮ নভেম্বর জাসদ ছাত্রলীগ কলাভবনে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। এই মিছিলে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-সহ বহু ছাত্র-ছাত্রী আহত ও গ্রেপ্তার হয়। বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় রণাঙ্গনে। দিনশেষে সিদ্ধান্ত হয় ক্যাম্পাসে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কখনো পুলিশ প্রবেশ করতে পারবে না। ক্যাম্পাস হয় মুক্তাঞ্চল। তিন দফা দাবিকে সামনে রেখে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেই লক্ষ্যে ১১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বটতলায় সমাবেশ ও সচিবালয় অভিমুখে মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করে। তৎকালীন সময়ের ছাত্রনতাদের থেকে জানা যায় কিছু নেতা স্বৈরাচারী এরশাদের প্ররোচনায় আন্দোলনের গতিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে। সেদিনই বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা তাই বটতলায় কিছু নেতার বিরুদ্ধাচারন করেন। আন্দোলন চলতে থাকে । মাজিদ খান শিক্ষানীতি বাতিল আন্দোলনের পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হলো ১৪ ফেব্রুয়ারি। সেদিনের ছাত্রসমাজ কার্জন হলের মুখে সামরিক জান্তার পুলিশের ব্যারিকেডের মুখে পড়ে।তারা বাধা উপেক্ষা করে এগুতে লাগলে তৎকালীন পুলিশ শুরু করে গুলি টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ ও জলকামান ব্যবহার।যার ফলে জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ুব, কাঞ্চন, দিপালী সহ বেশ কিছু শিক্ষার্থী নিহত হন এবং অসংখ্য শিক্ষার্থী আহত ও গ্রেফতারের শিকার হন। বেশকিছু লাশ গুম করা হয়েছিল। এর প্রতিবাদে ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। সেটাই ছিল স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সুচনা। সেই কারণেই ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। (কিন্তু ভালোবাসা দিবসের কারণে এটা ফিকে হয়ে যাচ্ছে বা ইতিহাসেই থেকে যাচ্ছে ব্যাপরটা) আন্দোলনের মুখে পরবর্তীতে শিক্ষানীতিটি স্থগিত করা হয়। ভালোবাসা দিবসটি আন্তর্জাতিক এবং এটা আমাদের সমাজ সভ্যতা বা সাংস্কৃতিক সাথে খুব বেশি মানানসই নয়। আমি এই দিবসটির বিরুদ্ধে নয়। তবে আমি মনে করি সেদিনের প্রতিবাদ স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সুচনার পাশাপাশি ছিল আমাদের ত্যাগ ও ছাত্র সমাজের গর্বের অধ্যায়। ভালোবাসার নব্য ধারায় আমরা যেন ভুলে না যায় কাঞ্চন দীপালীদের ঐ দিন একটা শিশুর ও মৃত্যু হয়েছিল। বারবার শ্বৈর শকুনরা আমাদের লাল সবুজ পতাকা ছেড়ে খামচে ধরে তাই ছাত্র তথা সচেতন সমাজের জন্য এই দিবসটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সেদিনের শহীদদের আত্মার প্রতি সম্মান জানানো পাশাপাশি এই দিন হতে পারে আমাদের মত গনতন্ত্র কামিদের জন্য হতে পারে অনুপ্ররণা।
লেখক :বেদুইন হায়দার লিও বঙ্গবন্ধু গবেষক।