প্রবাহবার্তা : অনেকে এটা বলে সমালোচনা করেন যে বঙ্গবন্ধু কেন তার প্রিয় দেশ যে দেশের মুক্তির জন্য তিনি তার যৌবন পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়েছেন সেই স্বাধীন ভুমিতে পা রাখার পরিবর্তে তিনি মুক্তির ২ দিন পর কেন বাংলাদেশ আসলেন কেন তিনি বৃটেন গিয়েছিলেন। আমি আমার লেখাতে সেটা ব্যাখা করার চেষ্টা করবো। ড.কামাল হোসেনের কাছে জানতে চেয়ে ছিলাম কারণ তিনিও ছিলেন সেই সফরে বঙ্গবন্ধুর সাথে। তিনি জানান দেশ স্বাধীনের খবর যখন তিনি পেয়ে গেছেন তখন তিনি জেলে বসেই পরিকল্পনা করেছেন দেশ পুর্নগঠনের। একটি সদ্য স্বাধীন দেশের প্রথম চাওয়া অনান্য দেশের স্বীকৃতি আদায়। ইতিহাস সাক্ষী বঙ্গবন্ধু সরকার কত কম সময়ে বিভিন্ন পরাশক্তি ও পশ্চিমা দেশগুলোর স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন। পাকিস্তান থেকে বঙ্গবন্ধু কেন সরাসরি বাংলাদেশে আসেননি এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে জানাও যায়।নতুন প্রজন্ম যারা ইতিহাস গবেষণা করে ও জানতে চাই তাদের উদ্দেশ্য লেখা।শুরুতে তেহরান যাওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। বিকল্প হিসেবে ছিল লন্ডন তিনি লন্ডনকেই বাছাই করেন।ড.কামাল হোসেন ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে কমনওয়েলথ ওরাল হিস্ট্রিজে এ নিয়ে বিস্তারিত বলেন।তিনি জানান, সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত আকাশপথ হয়ে বাংলাদেশে ফেরার রুট গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেনতারা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ওই নয় মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকা কামাল হোসেন জানান, তখনো পাকিস্তানের বিমানের জন্য ভারতের আকাশসীমা বন্ধ থাকায় এ ঝুঁকি নেয়নি ভুট্টো সরকার।বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ওই সময়ে খুবই জরুরি হয়ে পড়েছিল তাদের কাছে।কারণ বাংলাদেশে আটকে পড়া ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনাদের নিরাপত্তা এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুকে হত্যা বা ফাঁসি কিংবা দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে ঢাকার সঙ্গে ভবিষ্যতে কোনো ধরনের সম্পর্ক ধরে রাখার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যেত। তখন বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা ছিল মি.ভুট্টার একটা চ্যালেঞ্জ। সেদিন প্রটোকল ভেঙে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী গাড়ির দরজা খুলে স্বাগত জানানো যেমন নতুন জন্ম নেয়া বাংলাদেশ ও সে দেশের নেতা হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এর মান মর্যাদা অনেক বাড়িয়েছে, তেমনি মি.হিথকে কিন্তু তার স্বদেশে ও বিদেশে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যে মুক্তি পেয়েই ব্রিটেনে পা রাখবেন এমনটা প্রত্যাশা করেনি কেউই এমনকি তত্কালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীও অবকাশে ছিলেন।পাকিস্তান থেকে আসা বিমানটি হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণের মাত্র ১ ঘণ্টা আগে জানতে পারে ব্রিটিশ গোয়েন্দা বাহিনী।শেখ মুজিবুর রহমানের প্রটোকল কী হবে এ নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল ব্রিটেনের। তবে অন্যান্য ভিআইপি ভিআইপি মর্যাদার ব্যক্তির মতো বঙ্গবন্ধুকেও লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে অভ্যর্থনা জানান ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা। তখন শেখ মুজিবুর রহমানের পদবি স্পষ্ট ছিল না। ১৯৭০-এর নির্বাচনে জিতলেও তিনি সরকার প্রধানের দায়িত্ব পাননি বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও তখনো কোনো পদ গ্রহণ করেননি তিনি। তবু তিনি হিথ্রো বিমানবন্দরে কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের অভিবাদন পান।উল্লেখ্য, বিমানবন্দরে শীর্ষ যে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি ছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা স্যার হ্যারল্ড উইলসন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি সম্ভাষণ করেছিলেন, ‘গুড মর্নিং মি. প্রেসিডেন্ট’ বলে। আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ না করলেও অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন যে মুজিব তা অবশ্যই ব্রিটিশ নেতাদের মাথায় ছিল। ৮ জানুয়ারি সকালে লন্ডনে পৌঁছার পর সেখানকার ক্যারিজেস হোটেলে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। সেদিন সন্ধ্যাবেলা ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে তাকে বহনকারী গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিলেন হিথ।বঙ্গবন্ধুকে ওইভাবে গ্রহণ করতে গিয়ে দলে ও দলের বাইরে বেশ উষ্মার মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি।সাধারণত কোনো প্রধানমন্ত্রী অন্য প্রধানমন্ত্রীকে নিজ দপ্তরে গ্রহণ করেন।বঙ্গবন্ধু তখন কোনো পদে ছিলেন না।বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ সময় অন্তরীণ থাকার কারণে শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল ছিলেন তাই হিথের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার অবকাশ ছিল না তবে মাত্র ঘণ্টা খানেকের সাক্ষাতে যেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে সেগুলো বেশ গুরুত্বের দাবি রাখে।ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের আলোচনার পাশাপাশি হিথের সঙ্গে যে দাবিতে আলোচনা হয়েছে সেটা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে আলোকময় দিকটি উপস্থাপন করে। বঙ্গবন্ধু সব সময় বাংলাদেশের স্বার্থ মাথায় রেখে কাজ করতেন। আমাদের বর্তমান রাজনীতি বিদদের মত বিদেশে দেশের স্বার্থ বিক্রি করতেন না। বঙ্গবন্ধু ও হিথের আলোচনার বিষয়বস্তু জানা সম্ভব হয়েছে। কারণ এ নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে জবাবদিহি করতে হয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে উভয়ের মধ্যে কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তা।এছাড়া রিচার্ড নিক্সনকে পাঠানো হিথের একটি চিঠিতেও ওই বিষয়গুলোর সত্যতা পাওয়া গেছে বেশ কয়েকটি বিষয়ে অনুরোধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।প্রথম অনুরোধটি ছিল যেন শিগগিরই স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় । হিথকে আরেকটি অনুরোধ করেন বঙ্গবন্ধু যাতে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক সমর্থন দিতে ওয়াশিংটনকে অনুরোধ করেন। প্রকৃত অর্থেই ওই সাক্ষাতের মাস খানেক পর ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ব্রিটেন।এ স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।কারণটা আপনারা সবাই জানেন ব্রিটেনের ঐ সময়ের স্বীকৃতি পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় বেশ কয়েকটি কমনওয়েলথভুক্ত ও পশ্চিমা দেশ। বঙ্গবন্ধুর বড় অনুরোধকে হিথ যে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন তার প্রমাণ পাই নিক্সনকে লেখা চিঠিতে।হিথ তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে লেখা এক চিঠিতে অনেকটা কারণ দর্শানোর মতো লেখেন ব্রিটিশ ওইপ্রধানমন্ত্রী।(কারণ স্বাধীনতা যুদ্ধে আমেরিকা আমাদের বিরুদ্ধে ছিল) সেখানে লেখেন,
ওয়াশিংটন যেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।এছাড়া পাকিস্তানের নতুন নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো যেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তার জন্য তাকে আশ্বস্ত করেন নিক্সনের কাছে এ অনুরোধও রাখেন হিথ। এ অনুরোধ যে হাওয়ায় উড়ে যায়নি তার প্রমাণ ওই বছরেরই ৪ এপ্রিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ওয়াশিংটন।মুসলিম বিশ্বের চাপের মুখে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।অবশ্য এর পেছনে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপাচাপিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। পরে হাউজ অব কমনসে ব্রিটিশ সংসদ সদস্যদের প্রশ্নের জবাবে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হিথ বলেছিলেন, শেখ মুজিব ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে এলে তাকে আমি জানাই যে আমাদের নীতি হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের তিন দেশের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা।বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে সহায়তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব আমরা।ব্রিটেনে যাওয়ার আগেই ব্রিটিশ জনতার সামনে বঙ্গবন্ধু পৌঁছে গিয়েছিলেন।বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়া, গণহত্যা বন্ধ করা এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিখ্যাত ট্রাফালগার স্কয়ারে বিক্ষোভ করেছিল ব্রিটিশ জনতা। স্বাধীনতার কয়েক মাসের মধ্যে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়েছিল।কারণ এতে উভয় দেশের সঙ্গে কয়েক যুগব্যাপী উষ্ণ সম্পর্কের সূত্রপাত হয়, যা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক প্রমাণিত হয়।বলা যায় হিথের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বড় ধরনের টানাপড়েন ছাড়া বেশ মসৃণ হয়। তাহলে বলা যায় বঙ্গবন্ধুর ব্রিটেন সফর ছিল ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দেশের কারণে গিয়েছিলেন। তিনি জেল জীবন শেষে আন্দোলনে ক্লান্ত হয়ে অবকাশ যাপন করতে বিলেত ভ্রমণ করেন নি।সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য মাত্র ৩ বছরের মধ্যেই যে দেশ থেকে স্বাধীন হয়েছি তার নিকট হতে স্বীকৃতি আদায় করা । প্রিয় সমালোচনক বৃন্দ সমালোচনা ভালো তাতে গঠন মুলক অনেক বিষয়ের অবতারণা করা যায়। আমি ধারাবাহিক ভাবে বঙ্গবন্ধুর সমালোচনার জবাব দিতে চাই নিজে জানতে চাই আপনাদের জানাতে চাই। সেই সাথে সম্মান জানাতে চাই এই মহান নেতা কে। জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : বেদুঈন হায়দার লিও
বঙ্গবন্ধু গবেষক