প্রবাহবার্তা হাতিয়া সংবাদদাতা : ৯ এপ্রিল ॥ সোমবার বেলা ১১টা। নলচিরা ঘাটের পশ্চিম পাশে কালবৈশাখী ঝড়ে ডুবে যাওয়া বালু বোঝাই ট্রলার উদ্ধারের চেষ্টা করছে মাঝি মাল্লারা। অনেকেই চায়ের দোকানে বসে রাতে ঝড়ের তান্ডবের বর্ণনা দিচ্ছে। ঝড়ের পরেরদিন কেউ কেউ নদী পার হওয়ার জন্য ঘাটে এলেও আবহাওয়া ভাল না থাকায় সাহস করছে না। ছোট ছোট যাত্রীবাহী ট্রলার মালিকরা তাদের ট্রলার নদীতে নামাতে নিষেধ করছে মাঝি মাল্লাদের। ঘাটে যাত্রী পারাপারের সঙ্গে জড়িত লোকজনের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। ঠিক সে সময়ে এ্যাম্বুলেন্সে একজন রোগী নিয়ে ৪-৫ জন লোক এসে ঘাটে উপস্থিত নদী পার হওয়ার জন্য। অনেক অনুরোধের পর রোগী ও তার স্বজনদের নিয়ে একটি স্পিডবোট এই প্রতিকূল অবস্থায় নদী পার হতে ছেড়ে যায় নোয়াখালী দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার নলচিরা ঘাট।
ঘাটে কথা হয় রোগীর স্বজন আলতাফ হোসেনের সঙ্গে সে জানায়, গত সোমবার সকালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয় হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়নের ম্যাগফাশন এলাকার আবুল বাসার (৪০) নামে এই ব্যক্তি। সঙ্গে সঙ্গে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। কিন্তু হাসপাতালের সকল সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার করা হয়। হসপাতালে ভর্তি করানোর পরপরই বাইরে নেয়ার তাগিদ দেয়া হয় জরুরী বিভাগ থেকে জানি না তারা কেন এমনটি করেছে। পরে জানতে পারি হসপিটালে পর্যাপ্ত ডাক্তার নেই। আবহাওয়া ভাল নয়, নদী উত্তাল এরপরেও স্পিডবোটে তাকে নিয়ে রওনা দিতে হচ্ছে জেলা সদর হসপিটালের উদ্দেশে। তাই একজনকে বাঁচাতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আরও চার-পাঁচজন মিলে উত্তাল নদী পারি দিচ্ছি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এ্যাম্বুলেন্সের দায়িত্বে থাকা চালক এনাম উদ্দিন জানান, শুধু আবুল বাসার নয় গত এক সপ্তাহে আরও অনুমানিক ১৫ রোগীকে হাতিয়ার বাইরে ঢাকা ও জেলা সদর হসপিটালে নেয়া হয়েছে। তবে তাদের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন ছিল কিনা তা তার জানা নেই।
হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৫ সাল থেকে শুরু হওয়া দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার ৭ লাখ মানুষের চিকিৎসা ব্যবস্থার একমাত্র ভরসা ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। এই হসপিটালে জুনিয়র কনসালটেন্ট ও মেডিক্যাল অফিসারের পদ রয়েছে ২১টি। এরমধ্যে বর্তমানে কর্মরত রয়েছে ৪ জন। আবার কর্মরত ৪ জনের মধ্যে একজন হলেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা যিনি অফিসিয়াল কাজে সব সময় ব্যস্ত থাকেন। অন্য আরও একজন মেডিক্যাল অফিসার পরীক্ষা দেয়ার জন্য ছুটি নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করছেন। এখন শুধু দু’জন ডাক্তার এই হসপিটালে আউটডোর ও ইনডোরে রোগীদের দেখাশোনা করছেন। তবে গতবছর করোনা মহামারী শুরুর আগেই সরকারীভাবে এই হসপিটালে ১৬ জন ডাক্তার দেয়া হয়েছিল। গত এক বছরে বিভিন্ন সময়ে এসব ডাক্তার চলে যাওয়ায় এই শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, দুটি ওয়ার্ডে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ৭৯ রোগী ভর্তি আছেন। এরমধ্যে পুরুষ ১৪ মহিলা ২৫ ও শিশু ৪০ জন। দুইজন মেডিক্যাল অফিসার সার্বক্ষণিক এই ৭৯ রোগীকে সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর ফলে এই হসপিটালে আউটডোরে রোগী দেখা অনেকটা বন্ধ হয়ে গেছে। হসপিটালের মহিলা ওয়ার্ডের ৪৪নং বেডে ভর্তি নাছিমা আক্তার (৩০) নামে এক মহিলা। আলাপকালে সে জানায়, শরীর অসুস্থ হওয়ায় গত শুক্রবার তিনি হসপিটালে ভর্তি হয়েছেন। তার বাড়ি উপজেলার চরকিং ইউনিয়নে। প্রতিদিন সকালে একবার ডাক্তার আসে। রাতে কিংবা বিকেলে আর আসে না। কেন আসে না তা তার জানা নেই। রাতে জরুরী প্রয়োজনে ডাক্তারদের ডাকলেও তারা আসে না। এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার নাজিম উদ্দিন জানান, জরুরী ডাক্তার দেয়ার জন্য সিভিল সার্জনের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি। আপাতত হসপিটালের সার্ভিস দেয়ার জন্য হরণী ও চানন্দী ইউনিয়নের কর্মরত ভাসানচরে থাকা একজন মেডিক্যাল অফিসারকে হাতিয়ায় নিয়ে আসা হচ্ছে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলা করার মতো কোন অবস্থা এই মুহূর্তে হাতিয়া স্বাস্থ্য বিভাগের নেই বলে জানান তিনি।