‘গোপালগঞ্জের প্রত্যেকটা জিনিসের সঙ্গে আমি পরিচিত। এখানকার স্কুলে লেখাপড়া করেছি, মাঠে খেলাধুলা করেছি, নদীতে সাঁতার কেটেছি, প্রতিটি মানুষকে আমি জানি আর তারাও আমাকে জানে।…এমন একটা বাড়ি হিন্দু-মুসলমানের নাই, যা আমি জানতাম না। গোপালগঞ্জের প্রত্যেকটা জিনিসের সঙ্গে আমার পরিচয়। এ শহরের আলো-বাতাসে আমি মানুষ হয়েছি। এখানেই আমার রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছে।…থানার দুপাশে দোকান, প্রত্যেকটা দোকানদারের নাম আমি জানতাম। সবাইকে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতে করতেই থানার দিকে চললাম।’
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১৭৬-১৭৭
গোপালগঞ্জ শহরের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের কথা এভাবে নিজেই বলে গেছেন বঙ্গবন্ধু। এখানকার মানুষের কাছেও তিনি এক ধরনের ঘরের মানুষ। স্থায়ী বয়স্ক বাসিন্দা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কাউকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে দেখা যায় তাদের প্রায় প্রত্যেকের স্মৃতিতে একজন ‘উঁচা, লম্বা, ইয়া বড়, বিশাল, দীর্ঘ’ হয়ে তিনি বিরাজ করছেন, যিনি তাদের সেই শৈশব, কৈশোর বা তারুণ্যের সময় একবার অন্তত নাম ধরে ডেকেছিলেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু যখন বঙ্গ বন্ধু হয়ে ওঠেননি, তারও আগে থেকে তার সঙ্গে এ এলাকার মানুষের নাড়ির সম্পর্ক। স্কুলের দুরন্ত বালক থেকে তুখোড় ছাত্রনেতা, জাতীয় নেতা থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ও রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠা বঙ্গ বন্ধুকে তার জীবনের প্রতিটি পর্যায়ের সঙ্গে এই এলাকার মানুষের পরিচয়টা অনেক নিবিড়। মজার বিষয় হলো, বঙ্গ বন্ধু তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তার এলাকার মানুষের সামান্য প্রয়োজন, সংকট ও আয়োজনে সাড়া দিয়ে অসামান্য হয়ে আছেন, আজও। তারই এক ছোট্ট উদাহরণ দিলেন, গোপালগঞ্জের ব্যাংকপাড়ার বাসিন্দা আজিজুল হক। তার দাদার সঙ্গে বঙ্গ বন্ধুর বাবার পাশাপাশি জমি থাকার কারণে, জমি-সংক্রান্ত কাজে পরস্পরের সঙ্গে চিঠি চালাচালি হতো। সেই সূত্রে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পারিবারিক ফার্মেসির লাইসেন্সের জন্য স্বয়ং বঙ্গ বন্ধুর কাছে ছুটে যান আজিজুল হকের বাবা মঞ্জুরুল হক। এত ছোট বিষয় নিয়ে তার দ্বারস্থ হওয়ায় একটুও বির ক্ত হননি বঙ্গ বন্ধু। এ ছাড়া বঙ্গ বন্ধু গোপালগঞ্জে এলে রাস্তাঘাটে দেখা হলেও মঞ্জুরুল হকের সঙ্গে কয়েকবার কুশলবিনিময় করেছেন।
মুজিববর্ষে গোপালগঞ্জবাসীর ভাবনার কথা জানতে গিয়ে উঠে এসেছে এমনই সব টুকরো টুকরো ঘটনা, আপাতদৃষ্টিতে হয়তো যার অনেকগুলোই তেমন উল্লেখযোগ্য নয়, তবু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, ব্যি ক্ত মানুষের জীবনে কতটা ওতপ্রোতভাবে আজও জড়িয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে যারা স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, তাদের বেশির ভাগই আজ আর বেঁচে নেই। যারা বেঁচে রয়েছেন তাদের বেশির ভাগই এখন জীবন-সায়াহ্নে। তাদেরই একজন টুঙ্গি পাড়ার আবদুল হামিদ। বঙ্গ বন্ধুর সঙ্গে একই স্কুলে পড়েছেন তিনি, কয়েক ক্লাস নিচে। স্কুল ছুটির পর, দল বেঁধে যাদের সঙ্গে গাছ থেকে আম পেড়ে খেতেন বঙ্গবন্ধু, তাদের মধ্যে আবদুল হামিদও থাকতেন। এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ, চোখেও দেখেন না। বঙ্গ বন্ধুর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি আবেগি হয়ে পড়লেন– ‘দেখা হলেই কাছে এসে বুকে জড়িয়ে ধরতেন, এই কেমন আছিস! সবার প্রতিই এমন মহব্বত ছিল তার। ফুটবল খেলায় তিনি ছিলেন এক নম্বর, তার সঙ্গে কেউ পেরে উঠত না, হেড দিয়েই গোল করতে পারতেন’। রাজনীতিক হিসেবে, বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে বঙ্গ বন্ধুর দৃঢ়সংকল্পের কথা জানা গেল শহরের প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তি ত্ব ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যাংকপাড়ার মিটু সর্দারের কাছে। তৎকালীন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের গোপালগঞ্জ সফরের সময়কার একটি ঘটনা তিনি তুলে ধরেন। খাজা নাজিমুদ্দিন আগমনে প্রটোকল দেওয়ার নামে এলাকাবাসীর কাছ থেকে চাঁদা তুলছিল ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ ও প্রশাসন। এ ঘটনা জানতে পেরে বাধা দেন বঙ্গ বন্ধু। মিটু সর্দারের বর্ণনায়, ‘বঙ্গ বন্ধু তখন বললেন এই টাকা উনি নিয়ে যেতে পারবেন না। এই নিয়ে অনেক মিটিং হলো, আলোচনা হলো। শেষ পর্যন্ত সত্যিই উনি এই টাকা কিছুতেই নিয়ে যেতে দিলেন না। এই টাকা দিয়ে কলেজ হলো, কোর্ট মসজিদ হলো।’
ঘটনাটির উল্লেখ বঙ্গ বন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও আছে। এই কোর্ট মসজিদেই পরে সদ্য গঠিত আওয়ামী লীগের ঢাকার বাইরে অনুষ্ঠিত প্রথম সভা হয়েছিল। সেটিও এক দারুণ উত্তেজনার ঘটনা। জনসভা বন্ধ করার জন্য মসজিদের ভেতরে ১৪৪ ধারা জারি করে পাকিস্তান সরকার। কিন্তু এলাকাবাসী তা উপেক্ষা করেই লাঠিসোঁটা হাতে জড়ো হয় জনসভায়। বিপদেরআশঙ্কায় পুলিশ বঙ্গবন্ধুকেই অনুরোধ করে, তিনি যাতে তাদের সরে যেতে বলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী জনসভায় বক্তৃতা করার পরই সমর্থকদের মসজিদ প্রাঙ্গণ ছেড়ে যেতে আহ্বান জানান তিনি। মিটু সর্দার বলেন, ‘উনি তো বিশাল মানুষ, শারীরিকভাবেও। ছোটবেলা থেকেই ওনাকে দেখেছি। মুজিব ভাই বলে ডাকতাম। ওনার সঙ্গে মেশার তেমন সুযোগ হয়নি, কিন্তু ওনার ছোট ভাই শেখ নাসেরের সঙ্গে ওঠাবসা করেছি। আমি যখন স্কুলে পড়ি, তার অনেক আগে থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ওনার তৎপরতা দেখেছি, ৫৪ সালের নির্বাচনের সময়ও দেখেছি। গোপালগঞ্জ থেকে উনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন তখন। সে সময় থেকেই ওনার বক্তৃতা শোনার জন্য মানুষের খুব আগ্রহ ছিল, বড় কোনো জমায়েতে বক্তৃতা দিলে অনেক মানুষ জড়ো হতো। এখন যেখানে স্টেডিয়াম হয়েছে, সেখানে তখন একটা মাঠ ছিল, আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে তাকে বক্ত …তা দিতে দেখেছি কতবার! তখন তো মুসলিম লিগের দাপট অনেক, তার মধ্যেও অনেক মানুষ ছিল, যারা তার সমর্থক ছিল, বিশেষ করে যারা তরুণ, তাদের কাছে তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তরুণদের একটা বড় অংশ মুজিবভক্ত ছিল। ৫৪ সালের সে নির্বাচনে মুসলিম লীগের একেবারে ভরাডূবি হয়। মুসলিম লীগের এত প্রভাব-প্রতিপত্তি সত্ত্বেও, শুধু শেখ সাহেবের কারণে তাদের পরাজিত করা সম্ভব হয়েছিল। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের দাঁড়ানোর মতো পরিস্থিতিই ছিল না, উনি ছাড়া আর কোনো নেতার ওই অর্থে সেই লিডারশিপ ছিল না। সংগঠক হিসেবে তার অসাধারণ দক্ষতার পাশাপাশি আরেকটি যে গুণ ছিল, সেটি তার স্মৃতিশক্তি। সারা দেশ ঘুরে রাজনীতি করেছেন তিনি, কারও সঙ্গে একবার আলাপ হলে অনেক বছর পরও তিনি সেটা মনে রাখতেন। দেখা হলে নাম-ঠিকানা নির্ভুল বলে দিতে পারতেন, এ ধরনের তীক্ষ্ণ স্মৃতিশি ক্ত ছিল তার।’ গোপালগঞ্জের এই প্রবীণ আইনজীবী বলেন, ‘তারপর ৬৮-৬৯-এর দিকে এলো ছয় দফা আন্দোলন। আমি তো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম ৬২ সাল থেকে, বাম রাজনীতি। মোজাফ্ফর সাহেবের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। মুক্তি যুদ্ধের সময় তিনটা রাজনৈতিক দল ছিল, এক আওয়ামী লীগ, আরেকটা কমিউনিস্ট পার্টি, আরেকটা হলো ন্যাপ। ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রলীগ ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের পুরো শক্তি। তখন আমি কাছ থেকে দেখেছি বঙ্গ বন্ধুকে। একজন মহান নেতা। বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। আমরা সরাসরি যদিও ওনার দল করি নাই, তবে ওনার খুব ভক্ত ছিলাম। এখনো।’ গোপালগঞ্জের ব্যাংকপাড়ার আরেক প্রবীণ বাসিন্দা নান্না মিয়ার কাছে বঙ্গ বন্ধুর কথা জানতে চাইলে, শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে তিনি একটি জনসভার কথা বলেন। সংগত কারণেই, সদ্য স্ট্রোকের আঘাত সামলে ওঠা অশীতিপর এই বৃদ্ধ এখন আর সেই সভার সঠিক দিন-তারিখ মনে করতে পারেন না। তবে তিনি এইটুকু মনে করতে পারেন, সেদিন আসলে জনসভা ছিল মুসলিম লীগের। বেশ কিছুদিন ধরেই সেই সভার প্রচারণা চালিয়ে আসছিল তখনকার অত্যন্ত প্রভাবশালী দলটি। অন্যদিকে, বঙ্গ বন্ধু আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে হঠাৎ করেই একই দিন একই সময়ে পাল্টাপাল্টি জনসভার ডাক দিলেন। তেমন কোনো প্রচার-প্রচারণা ছাড়াই, আমতলার মাঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করেন তিনি। তার সেই দৃপ্তকণ্ঠ, অগ্নিবর্ষী বক্তৃতা শুনে মুহূর্তে ভরে যায় মাঠ। নান্না মিয়ার কথায়– ‘মুসলিম লীগের জনসভা ভেঙে মানুষ তখন ছুটে যেতে থাকে বঙ্গ বন্ধুর ভাষণ শুনতে।’
মুজিববর্ষে গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুকে খুঁজতে খুঁজতে থানা পাড়ার রশিদা খানমের কাছে যাই। তিনি বঙ্গ বন্ধুর দূরসম্পর্কের মামা, আবদুর রাজ্জাক খানের মেয়ে। গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের প্রথম জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন আবদুর রাজ্জাক, কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি কমরেড ফরহাদের শ্বশুর তিনি, অর্থাৎ কমরেড রীনা খানের বাবা। যিনি রাজা মিয়া নামে পরিচিত ছিলেন।
রশিদা খানমের বাবা ও তার পরিবারে কথা আমরা বঙ্গ বন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও পাই–
“থানার পাশেই আমার এক মামার বাড়ি। তিনি নামকরা মোক্তার ছিলেন। তিনি আজ আর ইহজগতে নাই। আবদুস সালাম খান সাহেবের ভাই। আবদুর রাজ্জাক তার নাম ছিল। অনেক লেখাপড়া করতেন, রাজনীতিও তিনি বুঝতেন। তাকে সবাই ভালোবাসত। এ রকম একজন নিঃস্বার্থ দেশসেবক খুব কম আমার চোখে পড়েছে…একজন আদর্শবাদী লোক ছিলেন। তার মৃত্যুতে গোপালগঞ্জ এতিম হয়ে গেছে বলতে হবে। লোকে তাকে খুব ভালোবাসত ও বিশ্বাস করত…তাকে লোকে ‘রাজা মিয়া’ বলে ডাকত। আমি রাজা মামা বলতাম।’
–অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১৭৭
আবদুর রাজ্জাকের পরিবারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আরও বলা হয়েছে– তিনি যখন গোপালগঞ্জে এক মামলার জন্য হাজিরা দিতে যেতেন, তখনকার কথা।
‘আবার পরের মাসে তারিখ পড়ল। আমি আগের মতো থানায় ফিরে এলাম। দুদিন সকাল ও বিকেলে সবার সঙ্গে দেখা হলো। রাজা মামা ও মামি কিছুতেই অন্য কোথাও খাবার বন্দোবস্ত করতে দিলেন না। মামি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। নানিও আছেন সেখানে। আমার খাবার তাদের বাসা থেকেই আসত।’ (–অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১৯০)
সেই ঘনিষ্ঠতার কথাই জানা গেল রশিদা খানমের কথায়– ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের খুব আপন লোক, আমাদের আত্মীয়। উনি আমার ফুপাতো ভাই, আমার দাদি আর ওনার নানি দুই বোন ছিলেন। আমার নানির বড় বোনের ছেলে হলেন বঙ্গবন্ধু। ওনার নানির মা আমার দাদির বড় বোন। উনি আগে এই গোপালগঞ্জ থানাপাড়ায় ভাড়াবাসাতে থাকতেন। পরে ব্যাংকপাড়ার দিকে একটা বাসা করেছিলেন। আমার আব্বা বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের লোক ছিলেন, আমার আব্বা তাকে খুব স্নেহ করতেন। আব্বাকে উনি মামা বলে ডাকতেন, আমার আম্মাকে মামি। আমার দাদি ওনার নানি হতেন। এই ছিল আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক। আমার আব্বা অনেক আগে রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন, গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রথম জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন তিনি। ১৯৬০ সালে তিনি মারা যান। আব্বার মৃত্যুর পরও বঙ্গ বন্ধু পরিবারের সঙ্গে আমাদের অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল। আমার মনে পড়ে, একবার জেল থেকে বেরিয়ে তাকে যখন গোপালগঞ্জের মানুষ ফুলের মালা দিয়ে বরণ করল, উনি লোকজন নিয়ে আমাদের এই কাছারিঘরে এসেছিলেন। সবার সঙ্গে কথাবার্তা শেষ হওয়ার পর উনি আমাদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে এখানেই ঘুমাতেন।’
‘বঙ্গবন্ধু যখন গোপালগঞ্জ কারাগারে ছিলেন, সেটা উনিশশত ষাট সালেরও আগে, তখন আমার আম্মা তিনবেলা ওনাকে খাবার পাঠাতেন। আমাদের বাসা থেকে থানা বেশি দূর না, দুই মিনিটের পথ। আমাদের পরিবারের সঙ্গে বঙ্গ বন্ধুর সব সময়ই এ রকমই ভালো সম্পর্ক ছিল। আমার আব্বার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে অনেক আলাপ করতেন উনি। উনি তো খুব অন্যরকম মানুষ ছিলেন। আমার আব্বার সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন ছিল, তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লেই তা বোঝা যায়। কোনো বিষয়ে পরামর্শ দরকার হলে বা কোনো কিছু জানতে হলে তিনি আব্বার কাছে আসতেন। আব্বার ওপর ভরসা করতেন। সেটা অবশ্য মুক্তি যুদ্ধের অনেক আগের কথা। আর একাত্তরে আমরা তখন ঢাকায় থাকতাম। মুক্তি যুদ্ধের পর ১০ জানুয়ারি উনি যখন দেশে ফিরলেন, আমার দুই ফুফু আর আম্মা তখন তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। উনি আমাদের খুব আপ্যায়ন করেছিলেন। আমার মাকে তিনি মায়ের মতোই দেখতেন। যদিও আমার মা বয়সে বঙ্গ বন্ধুর চেয়ে ছোটই ছিলেন।’
‘আমাদের বাসায় বঙ্গ বন্ধুর লেখা দুটি মূল্যবান চিঠি ছিল। আমার আব্বাও তাকে চিঠি লিখতেন। কারাগারের বন্দিত্বের সময়টায় তাকে বই পড়ার পরামর্শ দিতেন। তো বঙ্গ বন্ধু একবার উত্তর লিখেছিলেন, মামা আপনি সব সময় আমাকে বই পড়ার উৎসাহ দিতেন, কিন্তু ‘আমি সময় পেতাম না। এখন আমি জেলে এসে সে সময়টা পেয়েছি, বই পড়ছি।’
“আমার আব্বা সবারই খুব প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। উনি যখন মারা যান, তখন আমার ১৫ বছর বয়স। ছোট ছিলাম, ফলে বঙ্গ বন্ধুর সঙ্গে খুব বেশি কথা হওয়ার সুযোগ ছিল না। খুব বেশি মনেও নেই। পরে অবশ্য ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাসায় অনেক গিয়েছি। আমাদের খুব স্নেহ করতেন। আমার আব্বার কথা বলতেন। একবার আমার ভাইকে তিনি বলেছিলেন, ‘বাবর রে, মামা যখন শেষ বয়সে অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গেছেন, তখনো আমাকে চিঠি লিখেছেন।’ কিন্তু ‘দুর্ভাগ্যের বিষয়, ওইসব চিঠি আমরা সংরক্ষণ করতে পারিনি।”
এমনকি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও উনি গোপালগঞ্জে এলে প্রথমেই আমাদের বাসায় এসে আম্মার সঙ্গে দেখা করতেন, যত দিন বেঁচে ছিলেন, তাই করেছেন। ওনার স্ত্রীও আসতেন। আমার মনে আছে, তার গায়ের রং খুব ফর্সা ছিল, অনেক লম্বা চুল ছিল, গড়ন ছিল চিকন। ছেলেমেয়েদের মধ্যে শুধু শেখ কামাল তার সেই রং পেয়েছিলেন। ছোটবেলায় তাদের দেখেছি। দেশের প্রধান হওয়ার পরও আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নিতে কখনো ভোলেননি বঙ্গ বন্ধু। সবার খেয়াল রাখতেন, কে কেমন আছে।
বঙ্গবন্ধুর গোপালগঞ্জের ব্যাংকপাড়ার বাড়ির ঠিক পাশের বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন নূরজাহান আক্তার। জীবন-সায়াহ্নে পৌঁছে যাওয়া নূরজাহান আক্তারতার শৈশবে দেখা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু যে অনেক দীর্ঘকায় ছিলেন, তার উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘অনেক বড় ছিলেন তিনি। বাড়ির দেয়ালের ওপর দিয়েও তাকে দেখা যেত। আর যখন বাড়ি আসতেন, অনেক লোকজন থাকত তাকে ঘিরে। উনি এত লম্বা ছিলেন যে, দূর থেকে ওনাকে দেখতে পেতাম, আর অনেক লোকজনের আলাপ করত, শোরগোল শুনতাম, তবে কথা বুঝতে পারতাম না।’
শৈশবে দেখা অনেক কিছুই মানুষের কাছে অনেক বিশাল বলে মনে হয়, বড় হওয়ার পর যা ধরা দেয় স্বাভাবিক আকার নিয়ে। কিন্তু ‘শৈশবে নূরজাহান আক্তারের কাছে যাকে ‘অনেক বড়’ বলে মনে হয়েছিল, জন্মের একশ বছর পরও সেই মানুষটি ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ছায়া দিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষকে, বাঙালি জাতিকে। বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মহান নেতা ফিদেল কাস্ত্রো যেমন বলেছিলেন–‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি’।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক