প্রবাহবার্তা : নচিকেতার একটা গান শুনছিলাম শুয়ে শুয়ে। হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা পুরাতন বন্ধুর সাথে আলোচলা হলো ম্যাসেঞ্জারে। কথা প্রসঙ্গে উঠলো বাউল তত্বের কথা। গানেও শুনছিলাম নচিকেতা ও বাউল হতে চাই। গানের লাইন গুলো এমন
“কেউ হতে চায় ডাক্তার,কেউ বা ইঞ্জিনিয়ার,
কেউ হতে চায় ব্যবসায়ী,কেউ বা ব্যারিস্টার,
কেউ চায় বেচতে রূপোয়,রূপের বাহার চুলের ফ্যাশান,কেউ চায় বেচতে রূপোয়,রূপের বাহার চুলের ফ্যাশান,আমি ভবঘুরেই হব এটাই আমার অ্যাম্বিশন,আমি ভবঘুরেই হব এটাই আমার অ্যাম্বিশন” এই গানের শেষই নচিকেতা বলে আমি কোন বাউল হবো এটাই আমার অ্যাম্বিশন। বন্ধুর বাউল মতবাদ নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল।মুলত গেরুয়া পরে মাথায় বড় চুল রাখলেই তাকে বাউল বলা যায় না। মুলত বাউল একটা দর্শন। আমার বন্ধু অবশ্য বলেছিন এখন নিজেদের যারা বাউল মনে করে তারা কি জানে এই তোমার এই তত্ত্ব। আমার কথা হলো জানা না জানা ব্যাপার না তবে এগুলো জানলে ভালো। ঠিক তখনি মনে হল একটা কিছু লিখবো।
যদিও এটা একটি লেখায় শেষ করা যাবে না তাই আমি এটা নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখবো। শুরুতে একটু বাউল নিয়ে আলোচনা করি তার আগে বলতেই হয় আপাত দৃষ্টিতে বাউল শব্দটি শুনলে
আমাদের মনে পড়ে, কোনো ঘরছাড়া উদাসী সাধকের কথা, কিম্বা কোনো এক বিশেষ দর্শনের কথা কিম্বা কোনো মরমী গানের কথা। মূলত বাউল হলো এসকল অর্থের বিচারে যে কোনো একটি, আবার একই সাথে সকল অর্থের সমাহার। আক্ষরিক অর্থের বিচারে যাই থাক, বাউলের ভিত্তি হলো বহুবিধ ধর্ম-দর্শনে সৃষ্ট একটি তত্ত্ব। এই তত্ত্বকে যিনি মান্য করে স্বতন্ত্র জীবপযাপনের পথ বেছে নেন, তিনি বাউল বা বাউল সাধক।
বাউল শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে মতান্তর রয়েছে। কেউ বলেন ‘বাতুল’ থেকে ‘বাউল’ হয়েছে, কারো মতে ‘বজ্রী’ থেকে কিংবা ‘বজ্রকুল’ থেকে বাউল শব্দটি এসেছে। কেউ কেউ বলেন ‘আউল’ শব্দ থেকে ‘বাউল হয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, সতেরো শতকে বাংলাদেশে বাউল মতের উদ্ভব ও বিকাশিত হয়। বাংলাদেশে বিকশিত এবং চর্চিত বিশেষ ধর্ম-দর্শনের নাম বাউলতত্ত্ব। দেশী-বিদেশী বহু ধর্ম দর্শনের সংমিশ্রণে এই তত্ত্ব গড়ে উঠলেও, বাউলতত্ত্ব নিতান্তই বঙ্গদেশের। আমাদের নিজেদের। বাউলতত্ত্বের সাধকরা বেদ, বাইবেল বা কোরানের মতো মান্য করা যায়- এমন কোনো গ্রন্থ রচনা করেন নি।কিম্বা বিকশিত তত্ত্ব হিসাবে তা লিপিবদ্ধ করার দরকার আছে বলে বাউল সাধক রা মনে করেন না। আমরা যারা অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনা বিকশিত করতে চাই তাদের কাছে বাউল তত্ত্বের একটা লিখিত রুপ দরকার । বাউলদের কাছে ধর্মগ্রন্থের চেয়েও গুরু বড়। বাউল সাধকরা কোনো অলৌকিক গল্পকথা দ্বারা নিজদের দর্শনকে মহিমান্বিত করার চেষ্টাও করেন নি। বাউল সাধকদের ভাবনা গ্রন্থাকারে প্রচারের পরিবর্তে সংক্রামিত হয়েছে শিষ্যদের কাছে, শিষ্যদের মাধ্যমে। সে কথাও আবার সবার জন্য হয়ে উঠে নি। কারণ গুরুর বারণ- ‘বাউলের কথা বলিও না যথাতথা’। তাই বাউলতত্ত্ব পরিণত হয়েছে গুপ্তবিদ্যায়। এ বিদ্যার পারিভাষিক শব্দাবলির গভীরে লুকিয়ে আছে তাত্ত্বিক রহস্যময়তা। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় বাউল গুরুরা নিজেরাই নিজেদের কথা রাখেন নি। কারণ তাঁরা তাঁদের গানে গানে সর্বজনের কাছে তত্ত্বের গোপন কথা প্রচার করেছেন। কিন্তু ভাব সন্ধানের বিচারে সে গান কি সকলের হয়ে উঠেছে? নিতান্তই শ্রোতা হিসেব যাঁরা সুরের মোহে বাউল গানে মুগ্ধ হন, ভাবসন্ধানে এসে তাঁরাই অসহায় বোধ করেন বা কেহ তাহার সন্ধান করেন না বললেই চলে। গানের সুরে বাউল গান কাছে টানে, আর ভাবের সুরে বাউল মর্মের গভীর টেনে নিয়ে যায়।
আধুনিককালে আমরা তত্ত্বগত যা কিছু পাই, তার প্রাণভোমরা লুকিয়ে আছে আদিম মানুষের ক্রম বিবর্তনের তথ্যমালায়। তাই তত্ত্বের তথ্য পেতে হলে আমাদের কাঙালের মতো হাত পাততে হয়, আদিম কালের তথাকথিত অসভ্য মানুষের কাছে। সে সব মানুষের ব্যবহার্য দ্রব্যাদি থেকে জীবনযাপনের হদিস কিছুটা মেলে বটে, কিন্তু মনোদর্শন খোঁজাটা হয়ে যায় হাত বাড়িয়ে আকাশ ছোঁয়ার মতো অলৌকিক কল্পনার নামান্তর মাত্র । আদিম মানুষের অপরিসীম কল্পনার ভিতর দিয়ে জন্ম নিয়েছিল রূপকথা, ধর্ম বিশ্বাসের স্পর্শে এসে, তাই হয়ে গেছে কখনো কখনো পৌরাণিক গল্পগাঁথা। তাই অন্যান্য তত্ত্বের উৎস সন্ধানে আমাদের কালস্রোতের ভাটি থেকে উজানের দিকে যেতে হবে। উজানের পথে ছড়িয়ে রয়েছে রাশি রাশি তথ্য-রত্ন। সে সব রত্নকে সযতনে পাঠ করে করে আরও সুদূর অতীতের ঠিকানা জেনে নিতে হবে। তাই যে কোনো তথ্যানুসন্ধান মাত্রেই অতীতের পানে যাত্রা। গবেষক বা ঐতিহাসিকরা হলেন যে যাত্রাপথের অভিযাত্রী মাত্র। এভাবেই আমরা আমাদের এই উজান যাত্রায় যা কিছু গলাধঃকরণ করতে সমর্থ হয়েছি সেখান কিছু রস নিঃসরণের ক্ষদ্র অভিপ্রায় মাত্র।
বাউল তত্ত্বের রয়েছে কয়েক ধাপ আদর্শ। গুরুবাদ, শাস্ত্রহীন সাধনা, দেহতত্ত্ব, মনের মানুষ, রুপ স্বরূপ তত্ত্ব হচ্ছে বাউল তত্ত্বের আদর্শ সমূহ।
১। গুরুবাদ – গুরু হচ্ছেন শিক্ষক, পরামর্শদাতা, পথ প্রদর্শক, মুর্শিদ। তিনি মানব গুরু এবং পরম পুরুষ দুই-ই। তাকে ঘিরেই গুরুতত্ত্ব । যেমন গুরু সম্পর্কে লালনের সহজ সরল স্বীকারোক্তি — //যেই মুর্শিদ সেই তো রাসুল, ইহাতে নাই কোন ভুল,খোদাও সেই হয়; লালন কয় না এমন কথা, কোরানে কয়।।’
‘মুর্শিদ বিনে কি ধন আছে রে এই জগতে?মুর্শিদ চরন সুধা, পান করিলে হবে ক্ষুধা; করোনা দেলে দ্বিধা।যে মুর্শিদ, সেই খোদা //
২। শাস্ত্রহীন সাধনা – বাউলরা মনে করে আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় আচার পালন করে ‘মনের মানুষ’ পাওয়া যায়না। রীতি নীতি বিধান- বিহিতে কিছু নেই। তাই লালন গেয়েছিলেন-
//কার বা আমি কেবা আমার, আসল বস্তু ঠিক নাহি তার,বৈদিক মেঘে ঘোর অন্ধকার, উদয় হয়না দিনমণি //। //সত্য কাজে কেউ নাই রাজি সবই দেখি তা না না নাজাত গেলো জাত গেলো বলে এ কি আজব কারখানা//। //বেদ বিধির আগোচর সদাই কৃষ্ণপদ্ম নিত্য উদয়,লালন বলে মনের দ্বিধায় কেউ দেখেও দেখেনা //
৩। দেহতত্ত্ব – বাউল সাধকদের সাধনা দেহে উপর আশ্রয় করে গড়ে উঠে। কারন ঈশ্বর দেবতা সবই কাল্পনিক, মানুষের বিশ্বাস বিশেষ। সাধারন মানুষের জন্য এগুলো প্রতীক মাত্র। আসলে ‘পরম পুরুষ’ বাস করেন শরীরে।
তাই শরীরের সাধন শ্রেষ্ঠ সাধন। বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাস বলেছেন –//সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই//
৪। মনের মানুষ – মনের মানুষ হচ্ছে দেহস্থিত আত্মা। আত্মাই বহুনামের মানুষ – ভবের মানুষ, রসিক মানুষ, সোনার মানুষ, আলেক সাঁই ইত্যাদি। লালন তাকে স্মরণ করেন – //এই মানুষে আছেরে মন,যারে বলে মানুষ রতন।লালন বলে পেয়ে সে ধন, পারলাম নারে চিনিতে//
৫। রুপ-স্বরূপ তত্ত্ব – দেহ বা কান্তি চেতনাই সব। রুপ হচ্ছে নারী বা প্রকৃতি আর স্বরূপ হচ্ছে নর বা পুরুষ। রুপ এবং স্বরূপ এর দৈহিক মিলনেই সাধন সম্পূর্ণ হতে পারে। রুপ – সরূপ এর ভবের তাৎপর্য বুঝার জন্য হলেও তাদের মিলনের প্রয়োজন।
মূল বাউল তত্ব এর কোন জাত বিচার নেই। শ্রেণীহীন সহজ সরল জীবনের অভিসারী বাউলরা একেশ্বরবাদী, ত্যাগের আদর্শবাদী। কিন্তু সেই একেশ্বরবাদী সত্ত্বা মানেই আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর কিংবা প্রচালিত কোন সৃষ্টিকর্তা হতেই হবে এমন কোন বাধ্য নিয়ম নেই, অনেক বাউল-ই অদৃশ্য সত্ত্বায় বিশ্বাসী যাকে কোন নিদিষ্ট সৃষ্টিকর্তার আওতায় ফেলাকে এক অর্থে অসম্ভব ব্যাপার।
দুই বাংলার বাউল শিল্পীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল তিন দিনের বাউল সংগীত উৎসব।শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গনে আয়োজিত গত ২০১৮ সালের ২৬ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই দুই বাংলার যে বাউল উৎসব হয় সেখানে
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বাউল দর্শনের শান্তিবাদি মানবতার কথা ছড়িয়ে দেয়া ছিলর উদ্দেশ্য
‘সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদ মোকাবিলায় বাউল দর্শনের প্রয়োজনীয়তা’-এই বিষয়ের ওপর অনুষ্ঠিত হয় সেমিনার। সেখানে প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মহিত ও সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন মানবতার কল্যান সাধনে ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠনে বাউল দর্শন হতে পারে বড় মুক্তির পথ।
চলবে…………
বেদুইন হায়দার লিও
সাংস্কৃতিক কর্মী
তথ্যসূত্রঃ
মারুফ অমিত
হাফিজ সরকার
বাউল তত্ত্ব ও বাউল শব্দকোষ -রাজু অনার্য
বাউল তত্ত্ব – ড়. আহমেদ শরীফ